ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

আওয়ামী লীগের পুঁজি উন্নয়ন জামায়াত-বিএনপিতে দ্বন্দ্ব (মহেশখালী ও কুতুবদিয়া আসন)

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::   কক্সবাজার-২ আসনটি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। একসময় দ্বীপ দুটির বিচ্ছিন্ন জনজীবনের নানা সমস্যার খবর উঠে আসত গণমাধ্যমে। ছিল মানুষের অভাব-অনটন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন বদলেছে। এখন মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপের খবর হয়ে আসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী-ধলঘাটা ইউনিয়নে। বাস্তবায়িত হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক একাধিক বড় প্রকল্প। অন্যদিকে কুতুবদিয়া দ্বীপেও নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এসবই স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে এক প্রকার শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিরান হয়ে পড়েছিল মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ী ইউনিয়ন। প্রায় ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ, লাখ লাখ গবাদি পশুসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেই ঝড়-ঝঞ্ঝাপ্রবণ দ্বীপ মহেশখালীর বিরান জনপদে একে একে বাস্তবায়িত হচ্ছে পাঁচটি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আরো অনেক উন্নয়ন প্রকল্প।

সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার-২ আসনটি এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান পুঁজি হচ্ছে উন্নয়ন। আসনটিতে আওয়ামী লীগে যেমন একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন, তেমনি বিএনপিতেও একাধিক। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন এলাকায়।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে মনোনয়ন নিয়ে চলছে টানাটানি। এর কারণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের টিকিটে সংসদ সদস্য হওয়া জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদকে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতে মতবিরোধ।

জানা যায়, হামিদুর রহমান আজাদ সংসদ সদস্য হওয়ার দুই বছর পর থেকে আর এলাকায় আসেননি। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তিনি কোনো অবদান রাখতে পারেননি। এ কারণে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার আটটি ইউনিয়ন ছিল দীর্ঘদিন জোয়ার-ভাটায় সয়লাব। যদিও বা তিনি এলাকায় নেই; তবুও আগামী নির্বাচনেও ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হচ্ছেন—এমন প্রচার রয়েছে এলাকায়।

মহেশখালী উপজেলার একটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়নে মোট ভোটার দুই লাখ চার হাজার ৯৪৩ জন। কুতুবদিয়া উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়নে মোট ভোটার ৮৫ হাজার ৫৭২ জন।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কক্সবাজার-২ আসনটি সদর আসন হিসেবে পরিচিত ছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। এর আগে ১৯৭০ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন মো. ইসহাক। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আশেক উল্লাহ রফিক।

আওয়ামী লীগ : আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেতার জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেই যে প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার করবে, সেটা জানা গেল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগর দ্বীপ মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময়েই মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার প্রায় সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরে ও রাস্তাঘাটে সরকারের অনুদান নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেছে। গত চার বছরে এই দুই উপজেলায় অন্তত চার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে।

এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, সহসভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর কাছে পরাজিত আওয়ামী লীগ নেতা ড. আনসারুল করিম ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ ওসমান গনি।

মহেশখালী দ্বীপের বাসিন্দা সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট রফিক উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মহেশখালীর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা।

আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের জন্য কাজ করাই আমার রাজনীতি। তিনিই মনোনয়ন দেবেন। আমরা সবাই জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।’ মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। সেই সঙ্গে তিনি এই আসনটিতে বিজয়ের ব্যাপারেও অনুরূপ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আশেক উল্লাহ বলেন, মহেশখালী দ্বীপে একে একে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাতে এককালের দ্বীপাঞ্চলের অবহেলিত মানুষগুলো এখন সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের মতো শহরের স্বপ্ন দেখছে। এরই মধ্যে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে মহেশখালী দ্বীপের ধলঘাটা-মাতারবাড়ীর সরাসরি যোগাযোগের জন্য চার লেনের সড়ক নির্মিত হচ্ছে। এই মহাসড়কটি নির্মিত হলে বদলে যাবে মহেশখালী দ্বীপের চেহারা।

সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘মনোনয়ন দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তাঁকে বিজয়ী করাই আমাদের প্রধান কাজ।’

বিএনপি ও জামায়াত : কক্সাবাজার-২ নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী মহেশখালী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট থেকে যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল সেই জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ এখন এলাকায় নেই। তাই এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তিনি কাজ করতে চান। এ কারণেই বিএনপি নেতা আবু বক্কর সিদ্দিক এবার দলীয় প্রার্থী হতে চান।

তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আজাদ দাবি করেছেন, ২০ দলীয় জোট থেকে তিনিই মনোনয়ন পাচ্ছেন—এতে সন্দেহ নেই। বিগত সময়ে প্রতিকূল অবস্থার কারণে সরাসরি এলাকায় আসতে না পারলেও সার্বক্ষণিক নির্বাচনী এলাকার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। কঠিন সময়েও এলাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।

কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ কুতুবদিয়া দ্বীপের বাসিন্দা। কুতুবদিয়া দ্বীপে জামায়াতের ভোটব্যাংক রয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের দণ্ডাদেশ নিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপে নাশকতার ঘটনায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিল। সেই থেকে হামিদুর রহমান আজাদ এলাকাছাড়া। কিন্তু তার পরও তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা দ্বীপে তৎপর রয়েছে।

২০ দলীয় জোটের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরো আছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ টি এম নুরুল বশর চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ ফরিদ (আলমগীর ফরিদ)।

নুরুল বশর চৌধুরী বলেন, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপ নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের মধ্যে কুতুবদিয়া দ্বীপে বিএনপি সমর্থিত ভোট সবচেয়ে বেশি। তদুপরি তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে সব সময় রয়েছেন দ্বীপের রাজনীতির সঙ্গে। তাই বিএনপি হোক আর ২০ দলীয় জোট হোক, তিনিই মনোনয়নের দাবিদার।

জাতীয় পার্টি : বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ মুুহিবুল্লাহ।

মুহিবুল্লাহ বলেন, ‘এলাকায় সবাই ব্যর্থ। তাই পল্লীবন্ধু এইচ এম এরশাদকে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়। এরই মধ্যে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার পথে-প্রান্তরে আমি ঘুরে ঘুরে পল্লীবন্ধুর বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’

পাঠকের মতামত: